মোবাইল ফোনের কুপ্রভাব
মানুষ এখন টিভির চেয়ে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে বেশি অথবা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে অনেক বেশি ।
এক গবেষণায় দেখা গেছে – গড়ে মানুষ এখন দৈনিক সাড়ে তিন ঘন্টা থেকে সাড়ে চার ঘন্টা মোবাইল ফোনে কাটায় ।
গড়ে একটি মানুষ দিনে 58 বার মোবাইল ফোনটি হাতে নেয় ।
প্রেম ট্রেম করলে তো কথাই নেই ! উঠতে-বসতে ফোন-কেও হয়তো চুমু খায় ।
প্রতিদিন তিন ঘন্টার উপর ধরলেও বছরে একটি মানুষ 50 দিন মোবাইল ফোনে কাটায় ।
সে হিসেবে বছরে বারমাসের প্রায় দুই মাস কেটে যায় মোবাইল ফোন দেখে দেখে । জীবনের আর কী বাকী থাকে । আধুনিক মানুষের অদ্ভুত সব ব্যাপার স্যাপার ।
স্মার্টফোন মানুষকে কি আসলেই স্মার্ট করে তুলেছে ! নাকি মানুষ আগের চেয়ে আরো বেশি আনস্মার্ট জীবন যাপন করছে ।
যন্ত্রের সামনে বসে থাকতে-থাকতে মানুষের এই নিষ্ক্রিয়তা শরীরকেও খেয়ে ফেলে ।
যন্ত্রের আনন্দে বিভোর থাকে বলে শরীরের যন্ত্রণা ভুলে থাকে । কিন্তু যন্ত্র থেকে উঠিয়ে নিলে শরীর যে যন্ত্রনা শুরু করে, সেটা আবার কাটাতে পারে না ।
দেখা গেছে 30 থেকে 45 বছর বয়সের লোকেরা বেশি সময় এখন মোবাইল ফোনে কাটায় । কিশোর তরুণরাও এখন একই অনেক সময় দেয় ফোনে । অথচ কিশোর-তরুণদের আরো বেশি উদ্দাম এবং শারীরিক অ্যাকটিভিটিতে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল ।
মানুষ এখন গড়ে তিন ঘন্টা করে সময় দিলে তার দেড় ঘণ্টায় দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ।
আর ঠিক এই কারনে এখন দেখা গেছে যে- 40 এর আগেই অনেকের শরীরে ডায়াবেটিস এবং হার্টের বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে ।
সারা পৃথিবীতে এখন প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতি এগারোজনে একজনের ডায়াবেটিস । প্রায় 500 মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিস আক্রান্ত পৃথিবীতে । মানুষের সংখ্যা 8 বিলিয়ন, প্রায় ছয় বিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ।
বাংলাদেশে এখন 7 মিলিয়ন বা 70 লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত । 18 কোটি মানুষের মধ্যে 12 কোটি মানুষ হল প্রাপ্তবয়স্ক । এই 12 কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় এক কোটির কাছাকাছি লোকই ডায়াবেটিস আক্রান্ত ।
পাশের দেশ ভারতেও প্রায় 80 মিলিয়ন লোক ডায়াবেটিস আক্রান্ত এখন ।
সাথে কম বয়সে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মারা যায় এখন হার্টের বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ।
ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফোনের অলস জাতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রিটিশরা । গবেষণায় দেখা গেছে যে – ব্রিটিশ জনগণ গড়ে 3 ঘন্টা 15 মিনিট প্রতিদিন ফোনের পেছনে ব্যয় করে । শুধু ফোন নিয়ে অযথা বসে থাকার কারণে বছরে প্রায় 80 হাজার এর উপরে মৃত্যু হয় । সারা পৃথিবীতে এরকম অলসতার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে এখন মিলিয়নের মতো ।
পশ্চিমে সরকারগুলো শিশু কিশোরদের দৈনিক দেড় ঘণ্টার বেশি ফোনে সময় না দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের পরামর্শ দেন ।
বাংলাদেশ লোকজন গড়ে 4 ঘন্টার উপরে ফোনে সময় দেয় । 5 ঘন্টার উপরে সময় দেয় 28% এর মতো । এমনকি ছয় ঘন্টার উপরেও সময় দেয় 12 পার্সেন্ট এর মতো । তার মধ্যে আবার দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ।
ফোনের পেছনে এই নিষ্ক্রিয়তা কিডনি থেকে শুরু করে ডিপ্রেশন, আর্থ্রাইটিস থেকে শুরু করে হজম সমস্যা, ইমিউনিটি থেকে কার্ডিয়াক সমস্যা, কত কিছুতেই যে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, নিজেরাই জানেনা ।
তাহলে কি করবেন ?
• ফোনের ব্যবহার কমিয়ে দিন ।
• নিজেকে অ্যাক্টিভ করুন এবং অ্যাক্টিভ রাখুন ।
• দৈনন্দিন জীবনে পরিশ্রমের কাজ বাড়িয়ে দিন ।
• সে সুযোগ কম থাকলে ব্যায়াম করুন, হাঁটুন ।
• ঘরে মহিলারা কাজের লোকের উপর নির্ভর না করে নিজ হাতে কাজ করুন ।
• ফোনে বেশি অলস সময় না দিয়ে প্রিন্ট ফরমেটে ভালো একটি বই পড়ুন, গান শুনুন, প্রকৃতির কাছে যান, বাগান করুন ।
• সামাজিক সাক্ষাতে গল্প করুন, ফোনে নয় সাক্ষাতে কথা বলুন ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষকে এখন সবচেয়ে বেশি অসামাজিক করে তুলেছে । সামাজিক শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করে সবচেয়ে বেশি অসামাজিক করেছে মিডিয়াগুলো । এই দানবদের হাত থেকে বেরিয়ে আসুন ।
অ্যান্ড্রয়েড এবং অ্যাপেল, দুটোই একটি সিস্টেম রেখেছে তাদের প্রডাক্টগুলোতে এখন । সেটি হলো – স্ক্রিন টাইম ।
আপনি কত সময় স্ক্রিনে সময় কাটাচ্ছেন, তার একটি সাপ্তাহিক হিসাব দেবে আপনাকে ।
আমি নিজে এটি ব্যবহার করি । কতটা সময় আমি অপব্যয় করছি এখানে, তা বুঝতে পারি এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারি ।
সপ্তাহে আমার স্ক্রিন টাইম সাড়ে ছয় থেকে আট ঘণ্টা মাত্র । সে হিসাবে দৈনিক আমি 50 থেকে 60 মিনিটের বেশি ফোনে সময় দেই না । ধরে নিলাম গড়ে এক ঘন্টা ।
ফেসবুকে লেখালেখি করি । শুধু আমার লেখাটি লিখতেই এখানে আসি । মুখে মুখে ছোট ছোট লেখা লিখি বলে বেশি সময় লাগেনা । এমনকি এই লেখাটিও ফোনে কফি খেতে খেতে মুখে মুখেই লিখছি । সামাজিক মাধ্যমে খুব কম মানুষের লেখা পড়ি । তারচেয়ে বড় কথা – স্বাস্থ্যকে এবং শরীরকে নিরাপদ রাখি । সেটাই জরুরি । নিজেকে উদাহরণ দিয়ে নিজের কথাগুলো এই কারণেই বলা । অ্যাক্টিভ থাকি । কাজে কিংবা শপিং বা দূরে ঘুরতে যাওয়া ছাড়া কোথাও ড্রাইভ করি না । টিভি দেখি না তেমন । গোসল করতে করতে দিনের সবচেয়ে আনন্দময় গানটি শুনে ফেলি । রান্নাঘরে খাবারের আয়োজনে মেতে উঠলে কোন একটি ইন্টারেস্টিং ডিসকাশন ছেড়ে দেই, পডকাস্ট -এ আলোচনা শুনি । গুণী লোকদের লেকচার শুনি । সময় পেলে TED লেকচারে 20 মিনিটের মজার কোনো আলোচনা শুনে নেই ।
কাজের সময় কাজ, পরিশ্রমের সময় পরিশ্রম, বিনোদনের সময় বিনোদন, ঘুমের সময় ঘুম ।
No comments